Tuesday, August 6, 2013

‘কাজ করব, ফায়দা নেব না তা কী করে

এক রাতে ঢাকা বিলবোর্ডের রাজধানী বনে যাওয়া রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে। প্রথমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা এ বিষয়ে কিছু জানেন না বললেও এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন।
সোমবার আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বিলবোর্ড সাঁটানোর বিষয়ে বলেছেন, ‘বিএনপির অপপ্রচার ঠেকানোর কৌশলের অংশ হিসেবেই বিলবোর্ডে সরকারের উন্নয়ন প্রচার করা হয়েছে।’
সোমবার দুপুরে রাজধানীর পাবলিক লাইব্রেরিতে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত আলোচনা সভায় হানিফ বলেন, ‘আপনাদের (বিএনপির) অপপ্রচারে জাতি কিছুটা বিভ্রান্তি হয়েছে। তা থেকে কেটে উঠার জন্যই এ প্রচারণা।’
আর বিকেলে তো এ বিষয়ে রীতিমত বোমা ফাটিয়েছেন স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি বলেছেন, সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে রাজধানীতে এসব বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে।
শ্যামলীতে ইফতার পূর্ব এক সমাবেশ শেষে সাংবাদিকরা নানকের কাছে এই প্রচারণা সরকারের, না দল আওয়ামী লীগের তা জানতে চান। জবাবে তিনি বলেন, ‘এই প্রচারণা সরকারের, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের।’

নানক আরো বলেন, ‘আমি এবং আমার মন্ত্রণালয় জনগণের উন্নয়নে কাজ করল, তাহলে তো অবশ্যই আমি তার ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করব। ফায়দা নেব না তা কী করে হয়। বরং ফায়দা নেওয়াটাই স্বাভাবিক।’
মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাদেক খানের সভাপতিত্বে মূল অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ বজলুর রহমান, হাবিবুর রহমান মিজান প্রমুখ।
এর আগে অবশ্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বিলবোর্ড টানানোর বিষয়ে কিছু জানেন না বলে আরটিএনএন- কে বলেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন আরটিএনএন- কে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের প্রচার তো আওয়ামী লীগই করবে। দলের প্রচারের জন্য প্রচার সেল সব ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু এই বিলবোর্ড কে টানিয়েছে সেটা না দেখে কিছু বলা যাবে না।’
তবে তিনি বলেন, এটি আওয়ামী লীগ করলে সেখানে প্রচার সেলের নাম অবশ্যই থাকতো।
হঠাৎ করে সরকারের উন্নয়নের বিলবোর্ডে ছেয়ে যাওয়ায় নগরবাসীর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। অনেকে সরকারের এই কাজের সমালোচনা করেছেন। আবার অনেকে প্রচারণাকে বিদেশের উদাহরণ টেনে ইতিবাচক বলেছেন।
গত শুক্রবার এক রাতেই চেহারা পাল্টে য়ায় রাজধানী ঢাকার। যেদিক চোখ যায়, সেদিকে শুধু ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের উন্নয়নের সাড়ে চার বছর। সরকারের উন্নয়নের এসব প্রচারণায় ব্যবহার করা হয়েছে রাজধানীর বিভিন্ন মোড় ও সড়ক দ্বীপের বিলবোর্ড।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, অর্থনীতি, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতওয়ারি সরকারের সাড়ে চার বছরের উন্নয়ন চিত্র এসব বিলবোর্ড, ফেস্টুন ও পোস্টারের মাধ্যমে তুলে ধরে আরো উন্নয়নে সরকারের ধারাবাহিকতার কথা বলা হয়েছে। সঙ্গে আছে পবিত্র ঈদুর ফিতরের আগাম শুভেচ্ছার পোস্টারও।
তবে কারা এই বিলবোর্ড, পোস্টার টানিয়েছে তা স্পষ্ট নয়। বিলবোর্ড বা পোস্টারেও তার কোনো আলামত পাওয়ার উপায় নেই। অনেক এলাকায় বিলবোর্ডের আগের বিজ্ঞাপনের ওপর সেঁটে দেয়া হয়েছে সরকারের উন্নয়নের বিজ্ঞাপন।
এছাড়া অলিগলিতে লাগানো হয়েছে গত ৫ মে হেফাজতে ইসলামীর ঢাকা অবরোধের সংঘর্ষের চিত্র সম্বলিত পোস্টার। ‘সচেতন সমাজের’ সৌজন্যে হেফাজতিদের তাণ্ডব’ শিরোনামের এই পোস্টারে হেফাজতের বিরুদ্ধে শ’ শ’ কোরআন পোড়ানোর অভিযোগ করা হয়েছে।

সরকারি উন্নয়নের প্রচার সম্বলিত এসব বিলবোর্ড আর ‘সচেতনতামূলক’ পোস্টার বদলে যাওয়া রাজধানী এখন রাজনৈতিক বিতর্কের অন্যতম ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
বিলবোর্ড রাজনীতি নিয়ে সরকারি দল এবং বিরোধী দল পরস্পরকে কথার বাণ ছুঁড়ছেন। কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলছেন না। মুখ খুলেছেন দুদলের শীর্ষস্থানীয় নেতারাও। পক্ষে-বিপক্ষে তারা নানান যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন।
সরকারি দলের নেতাদের দাবি, বিরোধী দলের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সরকারের নেয়া এই উদ্যোগকে সঠিক বলে মন্তব্য করেছেন। এর মধ্যদিয়ে বিরোধী দলের অপপ্রচারে বিভ্রান্তির শিকার জনগণ সরকারের উন্নয়নের সঠিক চিত্র পাবে।
এদিকে, বিলবোর্ড প্রচারণার পেছনে অর্থ যোগানসহ এর উদ্দেশ্য নিয়ে সরকারের তীব্র সমালোচনা করছেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতারা। বিলবোর্ড প্রচারণা দিয়ে শেষ রক্ষা হবে না বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
অন্যদিকে, ইজারা ও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন এসব বিলবোর্ডের মালিকপক্ষ ও বিজ্ঞাপনদাতারা দারুণ ক্ষুব্ধ। অবহিত করা ছাড়াই কোথাও বিজ্ঞাপনের ওপর বিজ্ঞাপন সেঁটে দেয়া কিংবা ভাড়া হওয়া বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপন দেয়া বিপাকে পড়েছেন দুপক্ষই। তবে ভয়ে মুখ খুলছেন না তাদের কেউই।
প্রথমে সরকারি উন্নয়নের প্রচারণার বেনামি বিলবোর্ড থেকে জনমনে প্রশ্ন উঠে এই প্রচারণার অর্থায়ন সরকার নাকি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ করেছে। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিরোধী দলের নেতারাও।
শেষ পর্যন্ত সোমবার এক অনুষ্ঠান শেষে বিলবোর্ড প্রচারণার অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এসব বিলবোর্ড প্রচারণা স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের। আমাদের সেসব মন্ত্রণালয় উন্নয়ন করেছে, আমরা এর ফায়দা নেব না কেন? আমরা আমাদের উন্নয়নের চিত্র ঢাকাবাসী এবং পর্যায়ক্রমে দেশবাসীর কাছে তুলো ধরব।’
এদিকে, সরকারি দলের বিলবোর্ড প্রচারণায় জনগণ বিভ্রান্ত হবে না দাবি করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরে জনগণকে বিভ্রান্ত করা যাবে না। তারা সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে দিয়েছে।’
আজ আরেক অনুষ্ঠানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার বলেন, সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে নতুন নতুন কৌশল ও কথা বলছে। তাদের উন্নয়নের কথায় জনগণ বিভ্রান্ত হবে না, গত সাড়ে চার বছরে জনগণের কোনো উন্নয়ন হয়নি।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া আজ পৃথক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মিথ্যা প্রচারণার চালিয়ে কাজ হবে না। স্বৈরশাসক আইয়ুব খানও এমন প্রচারণা চালিয়েছিলেন। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের মুখে তাকে বিদায় নিতে হয়েছে।

No comments:

Post a Comment