Tuesday, August 13, 2013

লেজে গোবরে বিলবোর্ড চমক।

ইনকিলাব রিপোর্ট : প্রধানমন্ত্রীর বেশ কাছের মানুষ, সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্য বেশ হতাশা নিয়েই বললেন, গত প্রায় পাঁচটি বছর সরকার কে চালালো আমরা নিজেরাই বুঝলাম না। নেত্রী একাই তো সব করলেন। রাষ্ট্র, সরকার ও দলের জুতা সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সবই কেন তাকেই করতে হলো? সিনিয়র নেতা, মন্ত্রিসভা, দায়িত্বশীল এমপি, আমলা কেউই যেন কিছু পূর্ণরূপে করার ক্ষমতা বা দক্ষতা রাখেন না। কেবল প্রধানমন্ত্রীর অফিসই সবকিছুর নিয়ন্তা আর সব সিদ্ধান্ত এককভাবে প্রধানমন্ত্রীকেই নিতে হয়েছে। সাফল্য ও ব্যর্থতা সবই তার। কিন্তু একটি সংগঠন বা সরকারে তো আরো লোকজন আছে। সুখ দুঃখের ভাগ তো তাদেরও নেয়া চাই। সাফল্য ও ব্যর্থতার দায়ভাগ তো তাদের ঘাড়েও চাপবে। রাজধানী জুড়ে রাতারাতি বিলবোর্ড চমক। মাত্র দশ দিনের মাথায় এসব প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে খুলে ফেলা হচ্ছে। এত সমালোচনা ও নিন্দার মুখোমুখি কেন হলাম আমরা? কে বা কারা বিলবোর্ড লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার বলে তারা জানেনা, পার্টির লোকেরা বলে আমরাও জানিনা। তা হলে কে জানে? এসব কি ভূতে লাগিয়েছে? বিলবোর্ড ভাড়া নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কিংবা দলীয় দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে নির্ভুল তথ্য, রুচিশীল ডিজাইন, ছবি ও কালার নিশ্চিত করে এই প্রচারণার ব্যবস্থা নিলে, এত সমালোচনার মুখেও আমাদের পড়তে হতো না। কোটি কোটি টাকা খরচ করে টানানো বিলবোর্ড সাতদিনের মাথায় নামাতেও হতো না। যদি সাতদিনের জন্যও এসব ভাড়া নেয়া হয়ে থাকে তাহলে রমজানের শেষ সাতদিনের জন্য কেন নেয়া হলো না। যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ ঢাকায় আসা-যাওয়া ও চলাচল করেছে। ঈদের ছুটিতে যখন রাজধানীতে লোকজনই ছিল না তখন জনমানবহীন ঢাকায় কেন উন্নয়নের ফিরিস্তি টানিয়ে রাখা হলো? দেশে-বিদেশে সমালোচনা ও দেশবাসীর মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জশ দিয়ে সংশ্লিষ্টরা নীরব। শেষপর্যন্ত এ বিষয়টিও প্রধানমন্ত্রীকেই দেখতে হলো।
গত ৪ আগস্ট রাতে রাজধানীর শত শত বিলবোর্ডে বাণিজ্যিকভাবে টানানো বিজ্ঞাপন চিত্রগুলোর উপর ডিজিটাল স্ক্রিন সেঁটে দেয়া হয়। আলাদিনের চেরাগের দৈত্য এ কাজ করেছে বলে অনেকে মন্তব্য করেন। বিএনপির সিনিয়র নেতা এমকে আনোয়ার বলেছেন, ৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব বিলবোর্ডের জন্য সরকারকে জবাব দিতে হবে। বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, সরকার সত্য-মিথ্যার মিশ্রণ ঘটিয়েছে, অনেক অর্ধসত্য তথ্য প্রচার করেও মানুষকে ধোঁকা দিতে চেয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন, বিএনপি পারলে সরকারের ব্যর্থতাগুলোও বিলবোর্ডে প্রচার করুক। তারা সরকারের সাফল্য দেখতে পায় না বলে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার জন্যই এই বিলবোর্ড। দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, শুধু রাজধানীতে নয়, গ্রামে গঞ্জেও ডিজিটাল বিলবোর্ড লাগানো হবে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক বন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, তিনি ঢাকায় বিলবোর্ড লাগানোর ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, এসব সরকার লাগায়নি। সরকার লাগালে বিলবোর্ডে কর্তৃপক্ষ, দফতর বা বিভাগের উল্লেখ থাকত। ডিসিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে তাদের অজ্ঞতা প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন। এদিকে প্রথম আলোর ৪টি, ইউনিলিভারের ২০০ ছাড়াও রাজধানীতে ডিসিসি অনুমোদিত ৪ হাজার বিলবোর্ডের অনেকাংশই আকস্মিকভাবে দখল হয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মহলে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। বিলবোর্ড ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ বলেন, রাজধানীতে বিলবোর্ড ব্যবসায় তাদের মাধ্যমে অন্তত ২ হাজার ৪শ’ কোটি টাকার লেনদেন হয়। একমাস যদি সরকার এসব বিলবোর্ড দখল করে রাখে তাহলে ২০ কোটি টাকা গচ্ছা যাবে তাদের। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী কোনরূপ যোগাযোগ, ভাড়া বা চুক্তি ছাড়াই অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ড দখল করে নেয়ার ফলে বিলবোর্ড ব্যবসায়ী ১২০টি প্রতিষ্ঠানের অনেকেই শ্রমিক-কর্মচারীদের ঈদের বেতন বোনাস দিতে পারেনি। অনেক কোম্পানি তাদের সাথে কৃত চুক্তিও বাতিল করে দিতে চাইছে। সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ, এমনকি সরকারের অংশীদার বহু লোকও এ ব্যবসায় জড়িত। বিলবোর্ড চমকের আগপাছ চিন্তা না করে, কোনরূপ পরামর্শ না করে, যে কোন কর্ণার থেকে এমন একটি অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত যে সরকারের জন্য এতটা মারাত্মক ক্ষতিকর সাব্যস্ত হবে, তা সংশ্লিষ্টরা ভাবতেও পারেননি। বর্তমানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকেই এ বিষয়ে মুখ খুলতে এবং সমাধান দিতে হচ্ছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রফেসর বি. চৌধুরী বলেছেন, বিলবোর্ড দখল করে অর্ধসত্য ও কৌশলী প্রচারের জন্য সরকারের ক্ষমা চাওয়া উচিত। অপর সাবেক প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, বিলবোর্ড প্রচারণা সরকারের জন্য বুমেরাং হবে।  নেজামে ইসলাম নেতা মুফতী ইজহারুল ইসলাম বলেন, এ সরকারের অধীনে নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও অবাধ হবে তার নমুনা বিলবোর্ড দখল থেকেই বোঝা যায়। যারা নীতি-নৈতিকতার ধার না ধরে গায়ের জোরে বিলবোর্ড দখল নিয়ে সত্য-অর্ধসত্য প্রচারণা চালায়। আবার সরকার, পার্টি বা কর্তৃপক্ষ কেউই এই অপকর্মের দায় নেয়ার সাহস পায় না। এমন দলের হাতে দেশ, জনগণ, গণতন্ত্র ও রাজনীতি কতটুকু নিরাপদ এটাই প্রশ্ন।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সাবেকমন্ত্রী বলেন, ঐতিহ্যবাহী দল আওয়ামী লীগ এখন ভুল পথে চলছে। অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও পরীক্ষিত নেতাদের মূল্য দেয়া হচ্ছে না। নেত্রী নিজেও তার বিবেচনা সঠিকভাবে কাজে লাগাচ্ছেন বলে মনে হয় না। আমার কেন জানি মনে হয়, হাইব্রিড নেতা, বামপন্থ’ী নব্য আওয়ামী লীগার ও কচিকাঁচার পরামর্শেই তিনি ইদানীং অনেকগুলো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ধারণা করি বিলবোর্ডের সিদ্ধান্তও কোন কচিকাঁচার। রংপুরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, পুত্র জয়ই তাকে ডিজিটাল পদ্ধতি শিখিয়েছে, সম্ভবত জয়ের পরামর্শেই এই বিলবোর্ড চমক। দল, সংগঠন, সরকার ও প্রধানমন্ত্রীকে এত বড় একটা অন্যায় এবং বেঠিক সিদ্ধান্তের দিকে যদি কচিকাঁচারা ঠেলে দিয়ে থাকে তাহলে আওয়ামী লীগের কপালে দুঃখ আছে। কতটুকু কোণঠাসা হলে প্রধানমন্ত্রীকে বলতে হয়, আমরা সাতদিনের জন্য এসব বিলবোর্ড ভাড়া নিয়েছিলাম। এখন এসব অপসারণ করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বিলবোর্ডে প্রচারিত ভুল, অর্ধসত্য, অতিরঞ্জিত ও শুভংকরের ফাঁকিমূলক তথ্যের বিষয়ে ও ব্যাখ্যায় প্রতিবাদ বা পাল্টা বক্তব্য আসতে শুরু করেছে। অনেক সাফল্য এমনও দেখানো হয়েছে যা এ সরকারের আমলের নয়। কিছু প্রকল্প শুরু হতেও অন্তত ৫ বছর বাকি, সেসবও সাফল্যরূপে প্রচারিত হয়েছে। কিছু প্রকল্প মাত্র ফিতা কেটে উদ্বোধন করা হবে, এগুলোও সাফল্য। ৫০ ভাগ কাজও দীর্ঘ ৫ বছরে সমাপ্ত হয়নি, এমন প্রকল্পকেও বিলবোর্ডে সাফল্য হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। বহু প্রকল্প এমন আছে যেসব কাগজেপত্রে বাস্তবায়িত হলেও সংশ্লিষ্টরা এর সুফল এখনো হাতে পাননি। কিছু প্রকল্পে হিসাবের গড় পড়তা অংক দেখিয়ে শুভংকরের ফাঁকি দেয়া হয়েছে। যেগুলো নিয়ে ক্রমেই মিডিয়া সরগরম হয়ে উঠছিল। অপরিপক্ব চিন্তার বিলবোর্ড চমক যে সত্যিই বুমেরাং হয়ে যাবে কিংবা সস্তা প্রচারের এ নীতিবিবর্জিত উদ্যোগের যে এমন লেজে গোবরে অবস্থা হবে তা কিন্তু সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তরা আগে বুঝেননি। এমন বেসামাল কাজ করা হবে, দল মহাজোট বা সরকারের শরিকরা তা স্বপ্নেও ভাবেনি। এ নিয়ে দলের হিতাকাক্সক্ষী নেতাকর্মীরা বেশ বিরক্ত ও উদ্বিগ্ন।

No comments:

Post a Comment